সালাত শব্দের অর্থ কি

প্রিয় পাঠক আসসালামু আলাইকুম, আজকের এই টিউটোরিয়ালে আমরা সালাত শব্দের অর্থ কি এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, আপনি যদি সালাত শব্দের অর্থ কি এটা না জানেন তাহলে এই টিউটোরিয়াল টি আপনার জন্য যার মাধ্যমে আপনি সালাত শব্দের অর্থ কি এবং সালাত, ফরজ সালাত, সুন্নত সালাত, নফল সালাত, ওয়াজিব সালাত, তারাবি সালাত, জানাযার সালাত সকল সকল সালাত বা নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।  

সালাত শব্দের অর্থ কি আমরা অনেকেই স্পষ্ট জানি না। আমরা যারা নিয়মিত সালাত আদায় করি তাদের মধ্যে অধিকাংশেরও বেশী মুসলিম সালাত শব্দের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে অবগত নই।  অথচ এই সালাত হচ্ছে ইসলামের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রুকুনের মধ্যে একটি। যা আদায় ছাড়া একজন মুসলিম কখনোই নিজেকে মুমিন দাবি করতে পারে না। কিংবা এই সালাত ছাড়া একজন মুসলমানের ঈমান পরিপূর্ণ নয়। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত সালাত শব্দের অর্থ কি, সালাতের পরিচয় ও প্রকারভেদ ইত্যাদি সম্পর্কে জানা। আসুন আমরা উপরের উল্লেখিত বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি। 

সালাতের ইতিহাস

আমরা অনেকেই হয়তো মনে করি যে, সালাত বা নামাজ শুধুমাত্র উম্মতে মুহাম্মদীর জন্যই প্রযোজ্য হয়েছে। কিন্তু না, এই সালাত শুধুমাত্র আমাদের জন্য নয়। বরং আল্লাহ যতজন নবী রাসুল আঃ পাঠিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের জন্যই সালাত নির্দিষ্ট ছিলো। তবে সালাত আদায়ের পদ্ধতি ছিলো ভিন্ন ভিন্ন।

এই কারণে সালাত বা নামাজ এমন ইবাদত, যা সব আসমানি ধর্মে পাওয়া যায়। বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ কোনো যুগকে শরিয়তমুক্ত রাখেননি এবং কোনো শরিয়তকে সালাত বা নামাজমুক্ত রাখেননি।’ যেকারণে পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে সালাত বা নামাজের বর্ণনা এসেছে।

সালাত শব্দের অর্থ কি

সালাত শব্দটি একটি আরবি শব্দ। যা ইসলামী পরিভাষায় প্রার্থনা হিসাবে ব্যবহৃত করা হয়। আমাদের উপমহাদেশে সালাত শব্দটি ব্যাপক পরিচিত নয়। আমরা সালাতের পরিবর্তে নামাজ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। ফলে ফার্সি শব্দ নামাজকেই আমরা সালাত মনে করি। যদিও ইসলামিক বিখ্যাত স্কলাররা সালাতের পরিবর্তে নামাজ শব্দটি ব্যবহার করা পছন্দ করেন না। কেননা আরবি সালাত শব্দটির ব্যাপক অর্থ রয়েছে। কিন্তু ফার্সি নামাজ শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ইবাদতকেই বুঝায়।

যেকারণে আমরা নামাজ আদায় করা বুঝি না বরং নামাজ পড়া বুঝি। কিন্তু আরবি সালাত পড়া যায় না বরং সালাত আদায় করা এবং কায়েম করাকেই বুঝায়। এই কারণে সালাত শব্দের ব্যাখ্যা ও অর্থ নামাজ শব্দ থেকে যথেষ্ট ভিন্ন। সালাতের সরাসরি আরবি অর্থ করলে এর দুটি অর্থ পাওয়া যায়। যার একটি হলো আগুন বা একই সদৃশ উত্তপ্ত জিনিস। অপরটি হলো দোয়া বা প্রার্থনা।

আগুন বা একই সদৃশ উত্তপ্ত জিনিস এর উদাহরণ হিসাবে বলা যায় কুরআনের এই আয়াত, যেখানে বলা হচ্ছে,  ‘সাল্লাইতুল উদা বিন-নারি’ (আমি আগুন দ্বারা উদ প্রজ্বালিত করেছি)। এখানে সালাতকে আগুন হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।অপরদিকে দোয়া বা প্রার্থনা হিসাবে সালাতের ব্যাপক ব্যবহার কুরআনে রয়েছে। আল্লাহ বলেন তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে (আল্লাহর) সাহায্য প্রার্থনা কর। 

আমরা যদি সাধারণ অর্থে সালাত শব্দের অর্থ করি, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় যে, আল্লাহর কাছে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রার্থনা করা, দোয়া করা, ক্ষমা চাওয়া, রহমত চাওয়া, তাদের থেকে দয়া চাওয়া ইত্যাদি। কোরআনে নামাজকে ‘সালাত’ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে সালাত শব্দটি শুধু নামাজ অর্থেই ব্যবহৃত হয়নি।

কোরআন এ সালাত 

পবিত্র কোরআনে সালাত শব্দটি ১০০ বারের মতো এসেছে।  যার মধ্যে ৮৫ বার বিশেষ্য পদ হিসেবে আল্লাহ সালাত শব্দটি ব্যবহার করেছেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যারা অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সালাত কায়েম করে। একইভা‌বে ক্রিয়াপদ হিসাবে ১৫ বার এসেছে, যেমন—‘সে দান করেনি এবং সালাত আদায় করেনি। (সুরা কিয়ামা আয়াত ৩১)

সালাতের সংজ্ঞা

আমরা যদি সালাতের সংজ্ঞা জানতে চাই, তাহলে সালাতের সংজ্ঞা হবে, ইসলামী পরিভাষায় এমন একটি ইবাদত, যা নিয়ত থেকে শুরু করে তাকবীরে তাহরীমা, কিয়াম, রুকু, সিজদা, তাশাহুদের বৈঠকের মাধ্যমে সালাম ফেরানোকেই সালাত বলা হয়। অর্থাৎ ইসলামী সংস্কৃতিতে রুকু সিজদার মাধ্যমে প্রচলিত ইবাদতই হচ্ছে সালাত। যাকে আমরা উপমহাদেশে নামাজ হিসাবে চিনি। 

নিয়মিত এই সালাত প্রতিদিন পাঁচ বার আদায় করা একজন মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই সালাত অনাদায় থাকলে কিংবা নিয়মিত সালাত আদায় না করা ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক। যা এক পর্যায়ে একজন মুসলমানের ঈমানকে ধ্বংস করে দেয়। তাই প্রতিদিন সালাত আদায় করা একজন মুমিনের ঈমানের বহিঃপ্রকাশ। 

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে আমরা সালাতের নানান পরিচয় লাভ করে থাকি। যেমন পবিত্র কুরআনে সালাত শব্দটি প্রধানত ফরজ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ সালাত ইবাদতটি হচ্ছে সকল মুসলমানদের জন্য ফরজ তথা অবশ্যই পালনীয়। বিশেষ করে যখন তা জাকাতের সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ সুরা বাকারায় বলেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো।’( আয়াত : ৪৩)

এছাড়াও আল্লাহ সালাত শব্দটি অনুগ্রহ এবং অনুগ্রহ প্রার্থনা হিসাবেও কুরআনে এনেছেন। যেমন, সুরা বাকারার ১৫৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের প্রতি আছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে দয়া ও অনুগ্রহ।’ একইসাথে সুরা আহজাবের ৪৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারাও তোমাদের জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করে তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে আনার জন্য।’

সালাত শব্দটি ক্ষমা প্রার্থনা হিসাবেও কুরআনে এসেছে, তুমি তাদের (ক্ষমার) জন্য দোয়া কর, নিঃসন্দেহে তোমার (ক্ষমার) দোয়া তাদের জন্য সান্ত্বনা স্বরূপ। বস্তুতঃ আল্লাহ সবকিছুই শোনেন, জানেন। (সূরাঃ আত তাওবাহ, আয়াতঃ ১০৩) সালাত শব্দটি পবিত্র কুরআনে ইবাদতের স্থান হিসেবেও এসেছে। : আল্লাহ বলেন, আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে (খ্রীষ্টানদের) নির্ঝন গির্জা, এবাদত খানা, (ইহুদীদের) উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত, যেগুলাতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। (সূরাঃ হাজ্জ্ব, আয়াতঃ ৪০)

পবিত্র কুরআনে সালাত শব্দটি দরুদ হিসাবেও ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ এই সালাত শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠের অর্থেও ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ সুরা  আহজাবের ৫৬ নং আয়াতে বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা নবির প্রতি দরুদ  পাঠ কর এবং তাকে তাঁর সম্মান অনুযায়ী যথাযথভাবে সালাম জানাও।

সালাতের প্রকারভেদ 

সালাতের নানান প্রকার রয়েছে। আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল সাঃ আমাদের বিভিন্ন প্রকার সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।

ফরজ সালাত

প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা প্রতিটি ঈমানদারের জন্য ফরজ তথা অবশ্যই পালনীয়। যা অনাদায়ে শাস্তি এবং ঈমানহারা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ওয়াজিব সালাত

ফরজ সালাতের পর যে সালাত আদায়ের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাঃ গুরুত্বারোপ করেছেন, তাকে ওয়াজিব সালাত বলে। যেমন দুই ঈদের নামাজ হচ্ছে ওয়াজিব সালাত। 

সুন্নাত সালাত

রাসুল সাঃ ফরজ সালাতের পরে বা আগে যেসব সালাত নিয়মিত আদায় করতেন এবং তাঁর সাহাবীদের আদায়ের নির্দেশ দিতেন, তা হচ্ছে সুন্নাত সালাত বা নামাজ।  

নফল সালাত

ফরজ ওয়াজিব ব্যাতিরেকে যেসব সালাত রয়েছে, তা সবই নফল সালাত। এই নফল সালাত আদায়ে ব্যাপক সওয়াব রয়েছে তবে অনাদায়ে কোনো গুনাহ নেই। 

জানাজার সালাত

একজন মুমিন ব্যক্তি মারা গেলে তার জন্য দোয়া স্বরুপ একটি সালাত আদায় করা হয়, যাকে জানাজার সালাত বা নামাজ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে মুনাফিকদের উদ্দেশ্যে একটি আয়াত পাওয়া যায়। যেখানে আল্লাহ মুনাফিকের জানাজা আদায় না করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, "আর তাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু হলে তার উপর কখনও নামায পড়বেন না এবং তার কবরে দাঁড়াবেন না। তারা তো আল্লাহর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে এবং রসূলের প্রতিও। বস্তুতঃ তারা না ফরমান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছে।" (সূরাঃ আত তাওবাহ, আয়াতঃ ৮৪) এছাড়াও আমরা পবিত্র হাদীস থেকে জানাজার সালাত আদায়ের অসংখ্য দিকনির্দেশনা দেখতে পায়।  

সালাতুল খওফ

যুদ্ধাবস্থায়ও মুসলমানদের সালাত ছেড়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই যুদ্ধের পরিস্থিতিতেও বিশেষ পদ্ধতিতে সালাত আদায় করতে হয়। যাকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘সালাতুল খাউফ’ বা ভয়ের নামাজ বলা হয়।

সালাত শব্দের অর্থ কি, সালাতের পরিচয় ও প্রকারভেদ ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা এতক্ষণ বিস্তারিত জানলাম। আশাকরি এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনারা সালাত সম্পর্কিত সকল তথ্য পেয়ে গেছেন। আসুন আমরা নিয়মিত সালাত আদায় করি এবং অপরকে সালাত আদায়ে উদ্বুদ্ধ করি। 




 



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url