গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় কেন

গ্রীষ্মকাল হলো পৃথিবীর ৬টি প্রধান ঋতুর একটি, গ্রীষ্মকাল আমাদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঋতু, যা অনেক ধরনের কার্যকলাপ এবং পরিবর্তন নিয়ে আসে। এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং উদযাপনের সময়, কিন্তু তাপদাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মকালের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও সময়কাল রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রীষ্মকাল সাধারণত মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা প্রায় ৩০°-৪০°C (৮৬°-১০৪°F) পর্যন্ত উঠতে পারে। গ্রীষ্মকালে দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায় এবং রাতের দৈর্ঘ্য কমে যায়। এটি সূর্যের অধিক সময় ধরে উদিত থাকার কারণে ঘটে। গ্রীষ্মকালে কিছু সময় বৃষ্টিও হয়, তবে এটি বর্ষাকালের তুলনায় কম। বাংলাদেশে এপ্রিল-মে মাসে কালবৈশাখী ঝড়ও হয়ে থাকে, যা কিছুটা শীতলতা এনে দেয়।

গ্রীষ্মকালীন তাপ ও আর্দ্রতা ফসলের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে, বিশেষ করে ধান ও অন্যান্য শস্যের জন্য। তবে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও খরার কারণে ফসলের ক্ষতি হতে পারে। এই সময়ে গরম আবহাওয়া এবং সূর্যের তীব্রতার কারণে হিটস্ট্রোক, পানিশূন্যতা ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে, গ্রীষ্মকালে অনেক গাছপালা ও প্রাণীর জীবনে পরিবর্তন ঘটে। উদ্ভিদের দ্রুত বৃদ্ধি এবং ফুল ফোটা সাধারণ ঘটনা। মানুষ গরম থেকে বাঁচতে হালকা পোশাক পরিধান করে এবং ঠাণ্ডা পানীয় গ্রহণ করে। অনেকেই ছুটিতে যায় এবং পানির ধারে বা পাহাড়ে সময় কাটায়।

গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো পৃথিবীর অক্ষের কৌণিক অবস্থা এবং সূর্যের অবস্থান। পৃথিবী তার অক্ষে ২৩.৫ ডিগ্রি কৌণিকভাবে হেলানো। এই কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে সূর্যের আলো ভিন্ন ভিন্ন কোণে এসে পড়ে। গ্রীষ্মকালে নির্দিষ্ট অঞ্চলে সূর্য সরাসরি মাথার উপরে আসে বা কাছাকাছি অবস্থানে থাকে, ফলে সেই অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। গ্রীষ্মকালে নিরক্ষীয় অঞ্চলে সূর্য ক্রান্তীয় রেখার (Tropic of Cancer বা Tropic of Capricorn) উপর দিয়ে অতিক্রম করে। এতে করে নির্দিষ্ট অঞ্চলে সূর্যের তাপ সরাসরি এবং আরও দীর্ঘ সময় ধরে পড়ে। যেমন জুন থেকে সেপ্টেম্বর, যেখানে সূর্য ক্যান্সার ক্রান্তি রেখার কাছে থাকে। আর ডিসেম্বর থেকে মার্চ, যেখানে সূর্য মকর ক্রান্তি রেখার কাছে থাকে।

গ্রীষ্মকালে দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায় এবং রাতের দৈর্ঘ্য কমে যায়। দিনের সময় বেশি হলে সূর্যের আলো দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর পৃষ্ঠে পড়ে, ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। গ্রীষ্মকালে মাটি ও পানি সূর্যের তাপ শোষণ করে এবং সেই তাপ রক্ষা করে রাখে। মাটি এবং পানি রাতে শীতল হলেও দিনে পুনরায় তাপ শোষণ করে, ফলে সারাদিনে তাপমাত্রা বেশি থাকে। এবং গ্রীষ্মকালে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং মেঘ কম থাকে। এর ফলে সূর্যের তাপ সরাসরি পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছায়, যা তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে,  গ্রীষ্মকালে কিছু অঞ্চলে উচ্চ চাপ অঞ্চল তৈরি হয়, যা হট এয়ার মুভমেন্ট সৃষ্টি করে। এই বায়ুপ্রবাহ তাপমাত্রা বাড়ায়। এছাড়াও গ্রীষ্মকালে মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপ, যেমন শিল্প-কারখানার চলাচল, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, ইত্যাদি পরিবেশে তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষত শহরাঞ্চলে 'Urban Heat Island' প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, যেখানে কংক্রিট ও অ্যাসফাল্টের কারণে তাপমাত্রা বেশি হয়। উপরোক্ত কারণগুলো মিলিতভাবে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং পৃথিবীর ভৌগোলিক ও আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে।

গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ও কারণগুলো আরো বিস্তারিত ভাবে জানতে হলে, ভূগোল ও আবহাওয়া বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকগুলো বিবেচনা করতে হবে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সৌর বিকিরণ বা Solar Radiation পৃথিবীর তাপের প্রধান উৎস সূর্য। গ্রীষ্মকালে নির্দিষ্ট অঞ্চলে সূর্যের বিকিরণ সরাসরি এবং অধিক সময় ধরে পড়ে, ফলে সৌর বিকিরণ থেকে অধিক তাপমাত্রা সঞ্চিত হয়। গ্রীষ্মকালে সূর্যের রশ্মি পৃথিবীর পৃষ্ঠে প্রায় সরাসরি কোণে পড়ে, যা তাপ শোষণে অধিক কার্যকর। স্থলভাগ ও জলভাগের তাপমাত্রা ধারণের ক্ষমতা ভিন্ন। স্থলভাগ তাপ দ্রুত শোষণ ও নির্গমন করে, ফলে দিন ও রাতের তাপমাত্রা দ্রুত পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে, জলভাগ ধীরে ধীরে তাপ শোষণ ও নির্গমন করে। গ্রীষ্মকালে স্থলভাগের তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তা আশেপাশের বায়ুমণ্ডলের উপর প্রভাব ফেলে। বায়ুমণ্ডলের স্তরের মধ্যে পরিবর্তনও গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে এই স্তরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। গ্রীষ্মকালে ট্রপোস্ফিয়ারের উপরের স্তরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বাড়ে। ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে এবং এই প্রক্রিয়ায় তাপ তৈরি হয়। গ্রীষ্মকালে ওজোন স্তরের কার্যকারিতা তাপমাত্রার ওপর প্রভাব ফেলে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url